বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:৫১ পূর্বাহ্ন
মো. সামাদ খান, ফরিদপুর প্রতিনিধি ।।
ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে একটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করে।
এসময়, সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় মহাসড়কে অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষুব্ধরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার শেল ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এতে প্রায় ১৫ জনেরও বেশি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। বেশ কয়েকজন শর্টগানের গুলিতে আহত হন। এছাড়া অনেক পুলিশ ও কয়েকজন সাংবাদিক ইটপাটকেলে আহত হন। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও এপিবিএন পৌছে বিক্ষুব্ধদের হটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে পরে ফরিদপুর-খুলনা মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক না হলে ফরিদপুর র্যাবের কমান্ডারের নেতৃত্ত্বে ছয় গাড়ি র্যাব সদস্য সেখানে এসে পরিস্হিতি স্বাভাবিক করে,পরে যান চলাচল সাভাবিক হয়।
জানা গেছে, পঞ্চপল্লীতে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগের প্রতিবাদে সোমবার সকাল ৯ টার দিকে মধুখালী রেলগেটে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়।
মধুখালী ঈদগাহের সামনে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এতে শত শত মানুষ অংশ নেন। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভকারীরা দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে ঈদগাহ ময়দানে সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে তারা মিছিল সহকারে মহাসড়ক দিয়ে ঘটনাস্থল পঞ্চপল্লী অভিমুখে রওনা হয়। এসময় পুলিশ তাদের বাঁধা দিলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের বাধায় বিক্ষোভকারীরা খণ্ড খণ্ড হয়ে মিছিল করতে থাকেন। একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে মহাসড়কের মালেকা চক্ষু হাসপাতালের সামনে, নওপাড়ার মোড়, মাঝিবাড়ি, আড়কান্দি ও বাগাটের ঘোপঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। আড়কান্দিতে বিক্ষোভকারীরা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফলে অবরোধ করে এবং ঘোপঘাটে টায়ারে গুঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। বিক্ষুব্ধরা মহাসড়কে উঠে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলি ছোড়ে। তখন বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকে ইট ছুড়তে ছুড়তে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। নওপাড়ার মোড়ে একটি ইটভর্তি ট্রাক সড়কের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে রেখে বিক্ষোভ করা হয়।
খবর পেয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থলে পৌছেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার গিয়ে সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিক্ষোভ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। বিক্ষোভকারীরা তাঁদের ওপর পুলিশের গুলি ও হামলার প্রতিবাদ জানান। জেলা প্রশাসক এ ঘটনারও তদন্তের আশ্বাস দেন। বিক্ষোভকারীরা জেলা প্রশাসকের আহ্বানে সাড়া না দিলে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব গিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে কামারখালীর উজানদিয়া গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে সোহেল রানা (৪৫) নামে একজনকে এবং বিকেলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এপিবিএন সদস্য ওসমান (২৩), ফয়জুর (৩৭), ইবরাহিম (৪২) নামে তিনজনকে ফরিদপুরের বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া সংবাদ সংগ্রহ করতে যেয়ে স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন।
এদিকে, দুপুর সোয়া ২ টার দিকে প্রথমে যান চলাচলের চেষ্টা করলে আবার মরিচ বাজার মোড় মহাসড়কে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় আড়কান্দিতে পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবি রাস্তা থেকে গাছের গুড়ি সরিয়ে যান চলাচল করতে গেলে সেখানে মহাসড়কের ঢালে লুকিয়ে থাকা বিক্ষুব্ধরা ঢিল ছুঁড়তে থাকে। পরে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে হটিয়ে দেয়। এরপর বেলা সোয়া ৩ টার পর মহাসড়ক থেকে গাছের গুড়ি ও জ্বলন্ত টায়ার অপসারণ করার পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে।
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিরাজ হোসেন বলেন, ডুমাইনের পঞ্চপল্লীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধুখালী উপজেলার পাইলট স্কুল থেকে নওপাড়ার মোড় পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করে। কোথাও বুঝিয়ে শুনিয়ে কোথাও টিয়ারগ্যাস ও ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালায় পুলিশ। একারণে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসণে চেষ্টা করেও সাভাবিক করতে ব্যাথ্য হলে ফরিদপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব এসে পরিস্হিতি সাভাবিক হয়।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোহাম্মদ এমদাদ হুসাইন বলেন, বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়ছে। তবে এ ঘটনায় কোনো ব্যক্তি হতাহত কিংবা জানমালের ক্ষতি সাধনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।এদিকে এ ঘটনায় রাত সাড়ে ৮ টায় জেলা পুলিশের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করার পর পুলিশ সুপার বলেন,
ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লি এলাকায় কালি মন্দিরে আগুন দেওয়ার গুজব ছড়িয়ে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত অভিযোগ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার মধুখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফরিদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ওই ৮ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ৮ ব্যক্তি হলেন— রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দী উপজেলার আকশুকনা গ্রামের বিশ্বেশ্বর গ্রামের উজ্জ্বল কুমার মিত্র (৩৩), একই উপজেলার পুষআমলা গ্রামের বীরেন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে বিশ্বজিৎ মল্লিক (৫২), পাশের সাধুখালী এলাকার নানক বিশ্বাসের ছেলে কনক বিশ্বাস (২৭), ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জিনিস নগর এলাকার ফুলচরণ কুমার মন্ডলের ছেলে তপন কুমার মন্ডল (৪০), একই উপজেলার তারাপুর এলাকার ভানু রায়ের ছেলে অনুপ রায় (৩১), একই গ্রামের গিরিশ চন্দ্র মন্ডলের ছেলে টুটুল চন্দ্র মন্ডল (৩০), মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর এলাকার দিলিপ সরকারের ছেলে প্রসেনজিৎ সরকার (২০) ও একই উপজেলার বড়ালীদহ এলাকার কুমারেশ বিশ্বাসের ছেলে সুজয় বিশ্বাস (১৬)। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জানান, ইতোপূর্বে ১৯শে এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বিনয় সাহা (৬০), উজ্জ্বল কুমার বিশ্বাস (৪১), গোবিন্দ সরকার (২৮) ও অনয় ভাদুড়ী (১৯) নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন— অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইমদাদ হুসাইন (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর (সার্কেল) মো. সালাউদ্দিন, ডিবির ওসি আব্দুল মতিন সহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৭ টার দিকে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইনের পঞ্চপল্লিতে কালি মন্দিরে আগুন দেওয়ার সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে বাঁশ, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে আপন দুই সহোদরকে হত্যা এবং আরো ৫জনকে গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে মধুখালীর ইউএনও মামনুন আহমেদ অনীক এবং ওসি মিরাজ হোসেনের নেতৃত্বে হতাহতদের উদ্ধারে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদেরও জিম্মি করে হামলকারীরা।
খবর পেয়ে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার (পিএএ) ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম (পিপিএম বার) ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব প্রায় ৫ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এ সময় হামলাকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৭৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে পুলিশ। এ ঘটনার পরে মন্দিরে আগুন, নির্মাণ শ্রমিক হত্যা ও সরকারী কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে স্থানীয় থানায়। ঘটনার দুইদিন পর শনিবার (২০ এপ্রিল) ধর্মমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপি নিহতদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের শান্তনা দেন এবং পঞ্চপল্লীতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির তদন্ত চলমান রয়েছে। এছাড়া রবিবার (২১ এপ্রিল) ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম।